Mabia Hossain Vabna
9 min readJun 9, 2022

--

শাঁখারি বাজার ও তাঁর প্রত্নকথা(Shakhari Bazar and It’s Archeology)

Image is subject to Copyright

বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটি শহর ঢাকা। যার ইতিহাস প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো। পুরান ঢাকায় আজও এমন অনেক গলি রয়েছে যা বহন করছে শত বছরের পুরনো দালানের ইতিহাস। এই ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকা মুড়িয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক এলাকার আচ্ছাদনে। এরই মধ্যে একটি প্রাচীন এলাকা শাঁখারি বাজার। ঢাকার ইসলামপুর এবং নওয়াবপুর রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই শাঁখারি বাজার। দেখতে গেলে যা বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর অংশে। পুরো এলাকা জুড়ে বসবাসরত দের মধ্যে ৭০%-৮০% হচ্ছেন হিন্দু এবং বাকিরা অন্য ধর্মের। ইতিহাসের অনেক পাতায় শাঁখারি বাজার সম্বন্ধে বেশ তথ্য রয়েছে। সপ্তদশ শতকের মোঘল সুবেদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি ছিলেন মির্জা নাথান। তার লেখায় শাঁখারি বাজারের উল্লেখ্য রয়েছে।

নামকরণে নগরীটি এই এলাকায় বসবাসকারী শাঁখারিদের নামানুসারেই হয়েছে শাঁখারি বাজার। নগরীটি আগে থেকেই ঢাকার শাঁখারিদের আবাসিক এলাকা ছিল। অনুমান করা হয় বল্লাল সেনের আমল থেকে শঙ্খ শিল্পের প্রচলন শুরু হয়। ধারণা করা হয় বল্লাল সেনের শাসনামলে শাঁখারি সম্প্রদায় প্রথমে পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে বসতি স্থাপন করে। তখন তারা বিক্রমপুরে একটি বাজার শাঁখারি বাজার এ অবস্থান করতেন। সতের শতকে মোঘলরা ঢাকায় এলে শাঁখারিদেরকে খাঁজনা বিহীন লাখেরাজ জমি প্রদান করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তখন তারা ব্যবসায়ের উপযুক্ততা নির্ধারণ করে যে অঞ্চলে বসবাস করা শুরু করেছিলো তারই বর্তমান নাম শাঁখারি বাজার নামে পরিচিত। জেমস ওয়াইজের ১৮৮৩ খ্রিস্টব্দের বর্ণনা অনুসারে ঢাকায় ঐ সময় ৮৩৫ জন শাঁখারি বসবাস করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী এই শাঁখারি বাজার গুরিয়ে দিয়েছিলো। স্বাধীনতার পর শাঁখারিরা আবার এসে বসবাস শুরু করে এই জায়গায়। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার হিন্দু বসবাস করছেন এই শাঁখারি বাজারে।

১ম শতকে লিখিত Maduraikkanci ও Silappatikaram নামক তামিল ভাষার ২টি কাব্য থেকে জানা যায়, কোরকাই ও গুজরাটের নানা শহরে শঙ্খশিল্প বিকশিত হয়েছিলো। জেমস হরনেল মাদ্রাজ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত শঙ্খশিল্পের নিদর্শন দেখে ধারণা করেন, খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতকেই মহীশূর, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট, কাযিয়াবার প্রভুতি অঞ্চলে শঙ্খশিল্প বিকাশ লাভ করেছিলো। পরে বেশি লাভ করে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এবং ক্রমে ঢাকা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। কোরকাই থেকে ঢাকা শহরে শঙ্খশিল্প কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণ হিসেবে হরনেল মনে করেন, মালিক কাফুর কর্তৃক চতুদর্শ শতকে টিনেভেলি জেলার হিন্দুরাজ্য ধ্বংসের পর সে অঞ্চলের শঙ্খশিল্পিরা ঢাকায় চলে আসে। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেনের মতে, ঢাকায় স্বাধীনভাবেই শঙ্খ শিল্পের বিকাশ ঘটে। তিনি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বঙ্গনারীদের শঙ্খের ব্যাবহার লক্ষ্য করেই এই মন্তব্য করেছেন।

বর্ণনায় শাঁখারি বাজার পুরো এলাকাটি জুড়ে যতোগুলো বাসভবন রয়েছে তা অতি পুরনো। সরু গলির পাশ কেটে ভবনগুলোর অবস্থান। অতান্ত সমৃদ্ধভাবে সজ্জিত ও অঙ্কিত ইটের দালানগুলো আজ প্রায় অনেকটা পুরনো হয়ে এলেও দেখতে আজও ভীষণ মনকরা। একটি দালানের সাথে অপরটি একদম ঘেঁষে দাঁড়ানো। স্বতন্ত্র ধরনের দালানগুলোর মাঝে হালকাটুকু ফাঁকা জায়গা দেখা যাবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে জেমস ওয়াইজ বলেন, “শাঁখারিদের যে লাখেরাজ জমি দেওয়া হয়েছিল তা আয়তনে ছিলো অনেক ক্ষুদ্র, সেই আয়তন মেনেই নির্মিত হয় বাসগৃহ”। খানিকটা ঘুরলেই ধারণায় এসেযাবে যে এখানকার অধিকাংশ বাড়িগুলো চার তলা বিশিষ্ট। প্রতিটা বাসগৃহের মূল দরজাটি ছয় ফিটের মতো লম্বা। প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ ফিটের মত দীর্ঘ করিডোর চলে গিয়েছে ভিতরের দিকে। দালানগুলো পেছনের দিকে প্রায় বিশ গজের মত প্রসারিত। দরজা বা জানালা বিহীন মধ্যবর্তী দেয়াল গুলো একদম লাগানো। একতলার উপরের মধ্যবর্তী জায়গাটা আঙ্গিনার মত খোলা রাখা হয়েছে।

পূর্ব ঐতিহ্য ধরে রেখে শাঁখারি বাজারে আজও শাঁখারিদের হাতে শঙ্খ শিল্প দেখা যায়। ঠিক কবে থেকে শুরু হয় এই শঙ্খ শিল্পের? এমন প্রশ্নের উত্তরে শাঁখারি রণজিৎ সুর বলেন, কবে এর গোড়াপত্তন হয়েছিল, সে তথ্য কারোরই জানা নেই। তবে ধারণা করা হয়, রাজধানী ঢাকার জন্মেরও বহু আগে জন্ম হয়েছিল শাঁখারিবাজারে এ শাঁখা শিল্পের। এর উৎপত্তি ভারতে হলেও এ শিল্প বেশ সুখ্যাতি লাভ করেছে বাংলাদেশে। কুমার নাগ জানান, শাঁখা তৈরির মূল উপকরণ হচ্ছে সমুদ্রের কয়েক ধরনের শঙ্খ বা শামুক। যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য শামুকগুলো হচ্ছে- তিতুপটি, রামেশ্বরি, ঝাঁজি, দোয়ানি, মতিছালামত, পাটি, গাড়বেশি, কাচ্চাম্বর, ধালা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটি, এলপাকারপাটি, নাইয়াখাদ, খগা, সুরকিচোনা, তিতকৌড়ি, জাহাজী, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপটি ও আলাবিলা। এই শঙ্খ গুলো আনতে হয় শ্রীলংকার জাফনা ও ভারতের চেন্নাই থেকে। এগুলোর মধ্যে সব থেকে দামি তিতকৌড়ি। প্রতিটি তিতকৌড়ি শঙ্খ আনতে হয় তিন হাজার টাকায়। যার মূল্য ১৯২০ সালে পড়ত মাত্র ৩ টাকা। ২.৫ থেকে ৪ ইঞ্চি ব্যাসের শঙ্খ ব্যাবহার করা হয় বিভিন্ন মাপের শঙ্খবলয় তৈরি করতে। শঙ্খ ছাড়াও শাঁখা তৈরিতে প্রয়োজন পরে করাত, তেপায়া, টুল ও নুরান। তবে বর্তমানে প্রাচীন আমলের করাতের পরিবর্তে বিদ্যুৎ চালিত এক ধরনের গোলাকার করাত ব্যাবহার করা হয়। এখানকার শাঁখারিরা তাদের পূর্বপুরুষ এৈলক্যনাথ ধর এবং সাগর সুরের মতো প্রথিতযশা শাঁখা শিল্পের অনুসরণকারী। তারা এক সময় সাতচল্লিশের দেশ ভাগের আগে দেশ তাগ করে ভারতে চলে যান। ভারতের বাগ বাজারে এখনো এৈলক্যনাথের বংশধররা এই ব্যাবসা ধরে রেখেছে।

শাঁখা হিন্দু ধর্মের বিবাহিত নারীদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্ব ধর একটি অংশ। এমনকি শাঁখা বিহীন একটি হিন্দু বিবাহ সম্পূর্ণ করা অসম্ভব। একজন বিবাহিত হিন্দু নারীর জন্য শাঁখা ব্যবহারের মধ্যে থাকে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রচলিত প্রথা। এই প্রথার ভিন্নতা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে দেখা যায়। স্বামীর মঙ্গল কামনায় হিন্দু নারীগণ হাতে শাঁখা পরে থাকেন। তবে অনেক জায়গায় শাঁখা পরা একটি অপরিহার্য নিয়ম মানা হয়। এছাড়া স্বামীর মৃত্যু হলে সেই নারীর শাঁখা খুলে ফেলা হয় বা ভেঙ্গে ফেলা হয়। শাঁখা ব্যবহারের ইতিহাসের পেছনে কারণ জড়িত পুরাণে আছে, এক সতীসাধ্বী নারী যিনি তুলসীদেবী। তুলসী দেবী ছিলেন শঙ্খাসুরের স্ত্রী এবং ভগবান নারায়ণে বিশ্বাসী। অপরদিকে শঙ্খাসুর ছিলেন ভগবান বিমুখ এক অত্যাচারী। এক সময় তার পাপের শাস্তি হিসেবে নারায়ণ তাকে বধ করে ভারত মহাসাগরে ভাসিয়ে দেয়। স্বামীব্রতী তুলসী দেবী তা সইতে না পেরে নিজের এবং স্বামীর অমরত্বের জন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। ভগবান তখন তুলসী দেবীর প্রার্থনা মঞ্জুর করে তার দেহ থেকে তুলসী গাছ এবং সমুদ্রে হত্যা করা স্বামীর রক্ত ও অস্থি থেকে শঙ্খ বা শাঁখার উৎপত্তি করেন। সেই থেকে তুলসী দেবীকে চির স্মরণীয় করে রাখতে তুলসী ও শাঁখা ব্যবহারের প্রচলন হয়। একজন হিন্দু নারীর সতীত্বের প্রতীক হিসেবে শঙ্খকে গণ্য করা হয়। মনে করা হয়, এর পর থেকেই হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে বিবাহিত সম্পর্কের মাঙ্গলিক চিহ্ন হিসেবে এই শাঁখার প্রচলন ঘটে।

নানান শিল্পকর্মের কারণ ধরে শাঁখারি বাজার এলাকাটি ৫২ বাজার ৫৩ গলি নামেও বেশ পরিচিত। এলাকাটি যে শুধু শঙ্খ শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তা নয়। আছে এখানে পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্যে বেধে থাকা আরো বেশ কিছু শিল্প। অন্যতম শোলা শিল্প, শিল পাটা শিল্প, পাথর খোদাই শিল্প এখনো রয়েছে ঐতিহ্য অটল করে। স্থানীয়দের মধ্যে প্রায় অনেকেই এই ব্যাবসায় জড়িত রয়েছেন। এলাকার মধ্যেই দেখা যায় তাদের ব্যাবসায়ীক স্থান। লম্বা একটি রাস্তার মধ্যে দু’পাশ ধরে সারিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে পণ্যশালা গুলো। সজ্জাকরণের দিকে প্রাধান্য দিতে গেলে দেখা যাবে প্রতিটি দোকান শুধু মাত্র প্রয়োজনীয় পণ্য ধারাই সাজানো অতিরিক্ত কিছুই নেই ক্রেতাদের মন টানার জন্য। পুরনো দালানের নীচতলার সামনের অংশের জায়গাটুকু মূলত এসব পণ্যসালার স্থান। তবে কিছু কিছু দোকানের বেলায় দেখা যাবে সামান্য ভিন্নতা যা সম্পূর্ণটা ঘিরেই ব্যাবসায়ীক পরিবেশে আবদ্ধ। সাদা চুনের প্রলেপে দেয়াল গুলোর উপর থাকবে একটি পুরন্তের ছোঁয়া। রঙ বেরঙ্গের পণ্য গুলো সম্পূর্ণ পণ্য শালাটিকে একটি জ্বলন্ত প্রদীপে পরিণত করতে যেন বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এক একটি পণ্য শালা তার নিজস্ব পণ্যের উপর ভর করে আপন সুন্দর্যে খুব করে লিপ্ত।

শোলা শিল্পের প্রচলন এই শাঁখারি বাজারে ঠিক কবে থেকে তার আনুমানিকতা কারো কাছে নেই। তবে শোলা শিল্প অনেক প্রাচীন একটি শিল্প যা প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরনো। যারা শোলার কাজ করেন তাদেরকে মূলত মালাকার বলা হয়। এই মালাকার নামের পেছন ঘিরে রয়েছে লোকপ্রবাদ কারণ। কথিত রয়েছে, হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করার সময় শিব শ্বেত মুকুট পরার ইছা করেন। বিশ্বকর্মা যিনি দেবশিল্পী, মুকুট তৈরি করার জন্য উপাদানের কথা ভাবতেই শিবের ইছায় এক ধরনের উদ্ভিদ জলাশয়ে জন্ম নেয় যা ছিল শোলা। কিন্তু বিশ্বকর্মা শুধু মাত্র কাঠ বা পাথরের মতো শক্ত দ্রব্য ধারা কাজ করতে পারদর্শী, নরম দ্রব্য শোলার মতো দ্বারা নয়। তাই শিবের ইছায় তখন জলাশয়ে এক সুকুমার যুবকের প্রকাশ ঘটে। যাকে মালাকার নামে আখ্যাত করা হয়। যা বর্তমানে শোলা শিল্পীদের অভিহিত করা হয় হিন্দু সমাজ প্রথায়। মালাকাররা সাধারণত তাদের পূর্ব পুরুষদের নিয়মানুসারে তৈরি করে থাকেন দেবদেবীর অলঙ্কার, মালা, গহনা, খেলনা, বিভিন্ন নকশার টোপর, পূজামণ্ডপের অঙ্গসজ্জার দ্রব্যাদি, গৃহ সজ্জার নানা দ্রব্য। প্রতিদিন শাঁখারি বাজারের এই দোকান গুলোতে ভিড় জমে বিবাহের টোপর কিনতে আশা ক্রেতাদের। যার মূল্য এর নকশার উপর নির্ধারণ করা থাকে। সাধারণত কনে পক্ষ এই টোপর কিনতে হয় যার মধ্যে বর ও কনে উভয়েরই টোপর থাকে। এছাড়াও প্রতিদিন দোকানগুলো পূজা ও গৃহ দ্রব্যাদি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের সামাল দিয়ে থাকেন।সাধারণত বিভিন্ন বিল অঞ্চলগুলো যেমনঃ নওগাঁ, মাগুরা প্রভুতি স্থান থেকে শোলা নিয়ে আসা হয়। সূত্রধর ও কর্মকাররা বিশ্বকর্মার উপাসক হলেও মালাকাররা শিবের উপাসক। তাদের ধারণা শিবের ইছায় তাদের উপস্থিতি হয় তাই শিবই তাদের উপাস্য দেবতা।

যেখানে শিল পাটার অস্তিত্ব একাধারে বিলুপ্তের পথে সেখানে শাঁখারি বাজারে আজও দেখা যায় এই শিল্পের অবস্থান। তবে নতুন করে শুরু নয়। বংশক্রমে হাত ধরে যারা ছিলেন এখনো তাড়াই আছেন। এল সি এর মাধ্যমে পাথরের স্লাব ইন্ডিয়ার অন্দ্র প্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। রোজ হিসেবে কারিগরের মাধ্যমে তৈরি করা হয় শিল পাটা। এর পাশাপাশি রয়েছে শিল যাতাও, বাটি, খুরচুন, হাম্বল দিস্তা, রুটি বেলনি। ক্রেতাদের প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করে দেয়া হয় অন্যান্য গৃহ সামগ্রী। পুরনো এই পাথর গুলো সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন পুরনো জমিদার বাড়ি গুলো থেকে। এ ছাড়াও রয়েছে চন্দন পাটা যা পূজার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি এখানে দেখা যায় পাথর খোদাই শিল্প। ইতালি, ইন্ডিয়া ও মালায়শিয়া থেকে নিয়ে আসা হয় মার্বেল পাথর গুলো। যার মধ্যে ইতালিয়ান মার্বেল পাথর হচ্ছে সবথেকে ভালো। প্রতিটি নেম প্লেট তৈরি করতে সর্ব নিম্ন সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। একটি পাথর খোদাই এর পূর্বে তা পলিশ করতে হয়। পলিশ কার্য সম্পাদানের পর তার উপর প্রিন্টিং করা হয়। এর পর খোদাই করা হয়। পূর্বে এই প্রিন্টিং কাজ কারিগরগণ হাতের মাধ্যমে করতেন। তবে বর্তমানে এর সহজকরনে ও সময় নিবারণে হাতের কাজের পরিবর্তে কামিকেল এর মাধ্যমে প্রিন্টিং করা হয়। যার স্থায়িত্ব কম সময়ের হয়ে থাকে হাতের করা প্রিন্টিং এর তুলনায়। সর্বচ্চ ছয় মাসের মাথায় কামিকেল মুছে যেতে শুরু করে যেখানে হাতের কাজের প্রিন্টিং দশ বছরও স্থায়ী হয়ে থাকে।

এলাকাটি যে শুধু ঐতিহাসিক শিল্প দ্বারা আবদ্ধ তা নয়। এর বাহিরেও রয়েছে বহুবিধ ব্যবসায়ী। রয়েছে মাটির তৈরি নানান প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। যা দেখতে পাওয়া যাবে নানান রঙের অঙ্কনে। আছে সিলভার ও তামার হাঁড়িপাতিল এবং কাসার জিনিসপত্র। এছাড়াও রয়েছে কাপড়, মিষ্টি ও মুদির দোকান। এর মধ্যে বেশ কিছু দোকানে দেখা যাবে বাহারি রঙের টিপ। এতো এতো টিপের পাতার ভিড়ে হারিয়ে না গেলেই নয়। এলাকাটি কিন্তু আরও একটি কারণে বেশ সরগরম ফেলে ক্রেতাদের। গানের সকল প্রকারের বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যাবে এই শাঁখারি বাজারে। পাওয়া যাবে নাচ এর প্রয়োজনীয় সকল জিনিষ। প্রতিদিন এই শাঁখারি বাজার ভিন্ন প্রয়োজনের গ্রাহকের ভিড়ে হয়ে থাকে একদম গমগমে।

শ্রী শ্রী রক্ষা কালিমাতার মন্দির এই শাঁখারি বাজারের মধ্যে অবস্থিত। মন্দিরটি চার কাঠা জমির উপর নির্মিত। প্রধান মন্দিরটি চূড়া আকৃতির। এই মন্দিরের মায়ের মূর্তিটি সিমেন্ট দ্বারা তৈরি। মন্দিরটি ঘিরে রয়েছে বহু অলৌকিক ঘটনা। মন্দিরটি বর্তমানে রাধাকান্ত সূত্রধর, নিমাই চন্দ্র দে, কালিপ্রসাদসেন, তারাপদ পাল প্রমুখ বাক্তিবর্গ দ্বারা পরিচালিত রয়েছে। সপ্তাহের প্রতি শনিবার মন্দিরটিতে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য দিনের তুলনায় শনিবার ভক্তদের ভিড় থাকে অনেক বেশি। এছাড়াও এই মন্দিরে আমাবস্যার পূজাও হয়। এখানে কালি মায়ের পূজার পাশাপাশি শিবেরও পূজা করা হয়। মাকে যেমন সাজানো হয়েছে স্বর্ণালংকারে তেমনি শিবও স্বর্ণালংকারে সাজানো। মন্দিরটিতে শিবরাত্রি, শিবপূজা অনুষ্ঠিত হয়। অনেক বেশি ভিড় দেখা যায় কার্তিক মাসের কালী পূজায় এবং বাৎসরিক পূজায়। বাৎসরিক পূজা প্রতিবছর পৌষ মাসের ২১ তারিখে হয়। মন্দিরটি প্রতিদিন সকাল ৯ টায় খোলা হয়। রাজভোগ হয় দুপুর ১ টায় এবং রাত ৮ টার আরতির পরে মন্দিরটি বন্ধ হয়। দর্শনার্থীরা সাধারণত চাইলে মায়ের পূজা দিতে পারে। তবে এর জন্য সকাল ৮ টায় এসে এখানে যোগাযোগ করতে হয়। পাশাপাশি দর্শনার্থীরা মায়ের মন্দিরের ভিতরে গিয়ে বসতে পারে। শাঁখারি বাজারের পূর্ব মোড়ে অবস্থিত একটি শনি মন্দির রয়েছে। যা পরিচিত শ্রী শ্রী শনি দেব মন্দির হিসেবে। হিন্দু ধর্ম মতে শনি একজন দেবতা। শনিদেব কে শনিশ্চর বা শনৈশ্চর নামেও ডাকা হয়। জ্যোতিষীদের মতে, শনির বক্রদৃষ্টির ফলে যে ভালো কাজ করে তার ভালো হয় আর যে খারাপ কাজ করে তার সেরূপ শাস্তি হয়। এছাড়াও প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ বছরের পুরনো শ্রী শ্রী মহাকাল শিব বিগ্রহ এবং শ্রী শ্রী কালী বিগ্রহ রয়েছে এই শাঁখারি বাজারে।

সন্ধ্যে নামতেই চারপাশটা যেন নিঝুমতার বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে।তখন আকাশটা কখন রঙ বদলালো তা যেন দেখবার আর সময়টা নেই।এ পাশ ও পাশ থেকে বেরিয়ে আসবে ঘণ্টা, শঙ্খ আর উলু ধ্বনি।সাধারণত বলা হয় ঘণ্টা আর শঙ্খ বাজানো হয় ভক্তদের মন্দিরের দিকে আহবান করার জন্য। আর উলু ধ্বনি শুভ কাজের পবিত্রতা বাড়িয়ে তোলে এবং অশুভ কাজ সেই জায়গা থেকে বিতাড়িত করে। যে শব্দ উলু ধ্বনিতে উৎপন্ন হয় তা মান্য করা হয় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একটি মাঙ্গলিক কাজের সূচনা করে এবং একটা দৈব বাতাবরণ তৈরি করে যার মাধ্যমে দেবতাদের আশীর্বাদ পাওয়া যায়। এছাড়াও বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের মতে, উ হলো রাঁধা এবং লু হলো কৃষ্ণ তাই উলু ধ্বনি দ্বারা এই যুগলকেই স্মরণ করা বোঝায়। একদিকে যেমন পূজার কাজে বাস্ততা অপরদিকে তেমন পণ্যশালা গুলোতে ধূপকাঠি জ্বালাতে দেখা যায়। ক্ষণিকের মধ্যেই সম্পূর্ণ এলাকাটির বায়ুতে ছড়িয়ে পরে এক অন্য ঘ্রাণ। হটাৎ করেই পাল্টে যায় পরিবেশের রূপ। আকাশের রঙ যতোটা কালোর দিকে যেন ততোটা উজ্জ্বল হতে থাকে এই নগরী। তখন যেন আরো বেশি আকর্ষিক হয়ে উঠে এই নগরীর সুন্দর্য।

ইতিহাসের উপর ভর করে ঐতিহ্য ধরে রেখে এই শাঁখারি বাজারে শিল্পীগণ প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন এই শিল্প গুলো ধরে রাখতে। বর্তমানে বহু শিল্পীদের বংশধররা চাইছেন না তাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। তাদের মধ্যে কেউ হয়তো ছুটেছেন ভিন্ন ব্যবসায় নয়তো কেউ বেছেনিয়েছেন অন্য পেশা। এমনকি বর্তমানে অবস্থানরত শিল্পীদের দেখা যায় নানান সমস্যার মুখে জীবিত। অতি সামান্য লাভে শুধু মাত্র বংশগত ঐতিহ্যের হাত ধরে চলছে তাদের বেচে থাকা।

--

--